স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বিকশিত শিল্প-মাধ্যম থিয়েটার। এ কারণে থিয়েটারকে স্বাধীনতার শ্রেষ্ঠ শিল্পশস্য হিশেবে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু, কালের নিয়মে যখন থিয়েটার আমাদের কাছে এলো তখনো তার সংগ্রাম শেষ হলো না। বরং সংগ্রামমূখর মাধ্যম হিশেবেই থিয়েটার তার পরিচয়কে তুলে ধরল। নিরন্তর প্রতিকূল প্রতিবেশে চর্চিত বাংলাদেশের থিয়েটার ও তার কর্মীরা কখনো দমে যায়নি। বরং অপরিমেয় সাহস আর ভালবাসায় সমর্পিত হয়েছে নাট্যকর্মীরা। দ্রোহে-প্রেমে-প্রতিবাদে তারা ব্যবহার করেছে নাটকের বিশ্বস্ত সংলাপ। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গড়ে তুলেছে থিয়েটারের অহঙ্কৃত এক অবস্থান। নাট্যরচনা, নির্দেশনা, পরিকল্পনা এবং সাংগঠনিক যূথবদ্ধতা সবদিক দিয়ে থিয়েটার এখন অনেক বেশি সমৃদ্ধ। সামাজিক-রাজনৈতিক কর্মসূচি, মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ বিরোধী আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার লালন ও সম্প্রসারণ, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি-সহ মানবকল্যাণমুখী যে কোন কর্মকাণ্ডে নাট্যকর্মীদের বিপুল অংশগ্রহণ আমাদের আশান্বিত করে।

বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শিল্প-সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতি সবকিছুই তীব্র প্রতিকূলতার সম্মুখীন। এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে একজন নাট্যকর্মীকে আরো বেশি দক্ষ হয়ে ওঠা দরকার। তাকে হতে হবে শিল্পের আদি-অন্ত জ্ঞান সম্পন্ন। একজন নাট্যকর্মীর বিশ্বনাট্য পরিস্থিতি সর্ম্পকে সম্যক জ্ঞান থাকা চাই। বিশ্বনাট্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন সমূহ সর্ম্পকে থাকা চাই পর্যাপ্ত ধারণা ও নিজস্ব মূল্যায়ন। নিজস্ব সংস্কৃতি ও বাংলানাট্যের হাজার বছরের গৌরবোজ্জল ইতিহাস এবং ঐতিহাসিক বাঁক-পরিক্রমা সর্ম্পকে স্পষ্ট ধারণা থাকা চাই। নাটক নির্মাণ, অনুধাবন, বিশ্লেষণ এর বিসতৃত জ্ঞান থাকা চাই নাট্যকর্মীদের। আর এসবের জন্য চাই নাট্যকর্মীদের সম্মিলিত উদ্যোগ।

উপর্যুক্ত বাস্তবতায় নিবেদিত নাট্যকর্মীদের থিয়েটার অনুশীলন, শিক্ষণ, গবেষণা এবং উন্নয়নধর্মী কার্যক্রমের বিকল্প নেই। এ চিন্তাকে সামনে রেখে চট্টগ্রাম থিয়েটার সেন্টার-এর পরিকল্পনা।

চট্টগ্রাম থিয়েটার সেন্টার-এর থাকবে পাঁচটি বিভাগ। বিভাগগুলোর আওতা নিম্নরূপ-

লাইব্রেরি : নাট্যকর্মীদের চিন্তার জগতে ইতিবাচক পরিবর্তনের লক্ষে গড়ে তোলা হবে একটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরি। নাট্যসংশ্লিষ্ট দেশি-বিদেশী গ্রন্থ, জার্নালসহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা থাকবে এখানে, চট্টগ্রামসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে প্রকাশিত- অপ্রকাশিত নাটকের পাণ্ডুলিপির বিসতৃত সংগ্রহশালা হয়ে উঠবে লাইব্রেরিটি। লাইব্রেরিতে থাকবে পাঠকক্ষ। মাসের নির্দিষ্ট দিনে এখানে পরিচালিত হবে স্টাডি সার্কেল।

গবেষণা: নিরন্তর পরীক্ষা-নিরিক্ষা, গবেষণার মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়েছে থিয়েটার। চট্টগ্রাম থিয়েটার সেন্টার নাট্য গবেষণায় যুক্ত থাকবে এবং নাট্যগবেষকদের গবেষণার উপকরণ সরবরাহ করবে। পরীক্ষামূলক নাটক মঞ্চায়ন, মঞ্চায়িত নাটক নিয়ে সমালোচনামূলক আলোচনা অনুষ্ঠান আয়োজন এবং রচনা ও নির্মাণে আঙ্গিক নিরীক্ষায় উৎসাহিত করা গবেষণা সেল এর প্রধান লক্ষ্য।

উন্নয়ন: নাট্যকর্মীদের অভিনয়ের গুণগত মান-উন্নয়ন, মঞ্চসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে এবং সাংগঠনিক দক্ষতা উন্নয়নের লক্ষ্যে এ বিভাগ কাজ করবে। নবীন-প্রবীন নাট্যকর্মীদের সম্মিলিত অংশগ্রহণের মাধ্যমে কর্মশালা, মুক্ত আলোচনা, গোলটেবিল বৈঠক, নির্দিষ্ট প্রবন্ধের ভিত্তিতে সেমিনার আয়োজন প্রভৃতি কর্মসূচির মাধ্যমে সামগ্রিক নাট্যাঙ্গনের মান-উন্নয়নে সহযোগিতা করবে এ বিভাগ ।

প্রকাশনা: নাট্যাঙ্গনের সমৃদ্ধির জন্য প্রকাশনার গুরুত্ব অপরিসীম। থিয়েটার অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী মাধ্যম। তাকে বিচার-বিশ্লেষণ করে মহাকালে স্থায়ী আসন দিতে হলে নির্ভরযোগ্য প্রকাশনা প্রয়োজন। চট্টগ্রাম থিয়েটার সেন্টার নাট্য বিষয়ক গবেষণা ও গবেষণামূলক প্রবন্ধ, অপ্রকাশিত মৌলিক নাটক এবং বুলেটিন প্রকাশনার উদ্যোগ ও সহযোগিতা প্রদান করবে। এ-ছাড়াও প্রকাশনা বিভাগটি নাটকের অডিও-ভিডিও এবং নাট্যউৎসব ও সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমের ভিডিও ডকুমেন্টারি নির্মাণ করবে।

সংগ্রহশালা: একটি দেশের সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ দর্পণ থিয়েটার। থিয়েটার বহন করে জনপদের যাপিত জীবনের স্বরূপ থিয়েটার এবং থিয়েটার সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমের স্থায়ী সংগ্রহশালা হিশেবে থিয়েটার সেন্টার জাতির যাপিত জীবনের স্বরূপ ও সংস্কৃতির তথ্য-উপকরণ সংগ্রহের কাজ করবে। যাতে আগামী দিনের নাট্যকর্মীরা এখানে খুঁজে পাবে তার অতীতের সমৃদ্ধ থিয়েটার ও সংস্কৃতির বৈচিত্র্যময় রূপ। অতীত আর সমকালীন থিয়েটার চিন্তার সমন্বয়ে সে নির্মাণ করতে পারবে আগামী দিনের থিয়েটারের নতুন সড়ক।

এই মহতী চিন্তায় একটি ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা থিয়েটার সেন্টার। আমাদের বিশ্বাস- সবার সহযোগিতায় থিয়েটার সেন্টার- এর লক্ষ্য ও কর্মসূচি সফল হবে।